Header Ads Widget

Responsive Advertisement

সাম্প্রতিক খবর

6/recent/ticker-posts

পানচাষে স্বাবলম্বী দুর্গাপুরের চাষীরা

স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী কৃষি অঞ্চলের আওতাধীন বরেন্দ্রভূমিখ্যাত রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এই ‘বরেন্দ্র’ নামকরণের পেছনেও রয়েছে একাধিক পৌরাণিক কাহিনী। ‘বর’ অর্থ আশীর্বাদ এবং ‘ইন্দ্র’ অর্থ দেবতাদের রাজা। এক কথায় দেবরাজ ইন্দ্রের আর্শিবাদ রয়েছে এই অঞ্চলে।


পদ্মা-মহানন্দা-করোতোয়া নদী বেষ্টিত বরেন্দ্রভূমির অবস্থান গ্রীষ্মপ্রধান মৌসুমি মন্ডলে। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু এই অঞ্চল কৃষিকে এনে দিয়েছে সমৃদ্ধি। প্রকৃতি এখানে নিজেকে উজার করে দিয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে বরেন্দ্রজুড়েই।

শীতকালে প্রচণ্ড শৈত, গ্রীষ্মকালে প্রখর তাপমাত্রা এবং অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি মোকাবেলা করে ফসল ফলাতে হচ্ছে কৃষকদের। জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নিত্য বদলে যাচ্ছে চাষবাদের ধরণ। হেরে গিয়ে কখনো কখনো পথে বসছেন কৃষক।

এই অঞ্চলের অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে পান একটি। কৃষকের কাছে এটি কাঁচা সোনা। প্রতিদিন পানপাতা তুলে বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে পাচ্ছেন চাষি। তবে এখানেও দুর্যোগ পিছু ছাড়ছেনা চাষিদের। গেলা বর্ষা দীর্ঘায়িত হয়েছে বরেন্দ্রেজুড়ে। ভারি বর্ষণে তিন দফা বন্যা হানা দিয়েছে এই অঞ্চলে। মাঠের ফসল হারিয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন পানচাষিরা।

আঞ্চলিক কৃষি দপ্তর জানাচ্ছে, গেলো বছরের প্রথম দফা বন্যায় মাত্র ২ হেক্টর পানবজর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো। টাকার অংকে এই ক্ষতির পরিমাণ ৩৯ লাখ। বন্যা এখানেই শেষ হলে ক্ষতি কোনরকমে পুষিয়ে নিতেন চাষি। কিন্তু প্রথম দফা বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই হানা দেয় দ্বিতীয় দফা বন্যা।

এতে নতুন করে তলিয়ে যায় আরো ৪৩ দশমিক ২৫ হেক্টর পানবরজ। এতে আরো ৮ কোটি ৪৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয় চাষিদের। তৃতীয় দফা বন্যায় আরো ২৫ হেক্টর পানবরজ তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৪ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

তবে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৌশল বাতলেছেন পান চাষের সমৃদ্ধ রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার রৈপাড়া এলাকার চাষি মোহাম্মদ জনাব। জেলার দুর্গাপর উপজেলায় কয়েক প্রজন্ম ধরে পান চাষ করে আসছেন তিনি। গত দুই বছর ধরে ঠাঁঠাঁ বরেন্দ্রভূমি রাজশাহীর কাঁকনহাটে গড়ে তুলেছেন পানবরজ।

সরেজমিনে গিয়ে পানবরজেই পাওয়া গেলো চাষি মোহাম্মদ জনাবকে। তিনি ভাই ও ছেলেকে নিয়ে পানপাতা সাজাচ্ছিলেন। বরেন্দ্র এলাকায় একমাত্র পানচাষিও তিনি। কঠিন মাটিতে পানচাষ শুরুর গল্প শুনিয়েছেন অদম্য এই চাষি।

তিনি বলেন, পেয়ারা চাষের জন্য দুই বিঘা জমি লিজ নিয়েছিলেন। কিন্তু পেয়ার লাভ করতে পারেননি। তার বাবা পানচাষি ছিলেন। তিনিও পান চাষে যুক্ত বহুকাল থেকেই। তার প্রশ্ন ছিলো-এই মাটিতে অন্যান্য ফসল হলে, পান কেনো নেয়?

বছর দুয়েক আগে নেমে পড়ের পান চাষে। এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচা করে তৈরী করেন বরজ। ছয় মাস ধরে পানপাতা সংগ্রহ করছেন। নতুন বরজ, প্রতি সপ্তায় এখন হাজার-১২শ টাকার পান ওঠছে। এক বছর পর এই আয় বাড়বে অন্তত ৫গুন।

মোহাম্মদ জনাব আরো বলেন, বরেন্দ্র এলাকার লোকজন পানবরজের কাজ জানেন না। তাই বাইরে থেকে কর্মী আনতে হচ্ছে। অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বরজে কাজ করছেন। তাছাড়া খুচরা বাজার থাকলেও পানের স্থানীয় পাইকারি বাজার নেই। ফলে পানপাতা সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য দুর্গাপুরের হাটে তুলতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে খরচা। কমছে লাভের পরিমাণ।


কথা হয় মাড়িয়া গ্রামের পানচাষী রুহুল আমিনের সাথে। তিনি জানান, ‘আমি মিঠাপান চাষ করি। ২০ বছর ধরে আমি এই পানচাষের সাথে জড়িত আছি। এর আগে আমার বাপ-দাদা পানচাষ করতো। ৫ কাঠা জমি জুড়ে আছে আমার পানের বর। এই পানের বরে এক বছরে খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। আর এখান থেকে আমি বছর শেষে ২ লক্ষ টাকা লাভ করবো আশা করছি।’

পানানগর ইউপি’র মিরপুর গ্রামের পানচাষী মোজাহার আলী সরদার। তিনি জানালেন এলাকায় প্রথম পানচাষ শুরু করেন তাঁর পূর্বপুরুষরা। তাদের হাত ধরেই অত্র এলাকায় বিস্তার লাভ করে পানচাষ। পারিবারিক পানচাষে চতুর্থপ্রজন্মে এসে পড়েছেন তিনি। পানচাষে যেমন সম্ভাবন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সংকটও এমনটাও জানালেন মোজাহার আলী।

শুধু পানচাষি মোহাম্মদ জনাব, রুহুল আমিন, মোজাহার আলীই নন, দুর্গাপুরে তাদের মত শত শত চাষি পান চাষ করে এখন স্বাবলম্বী।

বরেন্দ্রজুড়ে পান চাষের এই সংকটের কথা স্বীকার করেছেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাসছুল হক। তিনি বলেন, পানচাষের জন্য প্রধাণত উঁচু জমি লাগে। পানে লাভ পাওয়ায় বিগত কয়েক বছর ধরে চাষি বৃষ্টি হলেও হাঁটু পানি জমে যায় এমন নিঁচু জমিতেও পান চাষ করছেন। এবারের কয়েক দফা বন্যায় জেলার মোহনপুর, দুর্গাপুর ও বাগমারায় বেশকিছু পানবরজ ডুবে গেছে। এতে পানচাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

রাজশাহী পানের জন্য বিখ্যাত জানিয়ে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, গতকয়েক বছর ধরেই পান এই অঞ্চলের অন্যতম অর্থকারী ফসল হয়ে উঠেছে। কেবল লাভের আশায় ঢালাওভাবে পান চাষে কৃষিকদের উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ নেই। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারিভাবে পান চাষ সম্প্রসারণের পরিকরল্পনাও নেই। তবে কৃষক নিজ উদ্যোগে বরেন্দ্র এলাকায় পান চাষ করলে তারা পরামর্শ দেবেন।

আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, লাভজন হওয়ায় প্রতিবছরই রাজশাহী অঞ্চলে বাড়ছে পান চাষ। ২০১৬-১৭ কৃষিবর্ষে রাজশাহী জেলায় পান বরজ ছিলো ২ হাজার ১৯৬ হেক্টর। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৮৪ হেক্টরে। ২০১৮-১৯ কৃষিবর্ষে পান চাষের আওতা বেড়ে দাঁয় ২ হাজার ৮৮৯ হেক্টর। সর্বশেষ ২০১৯-২০ কৃষিবর্ষে রাজশাহীতে ৪ হাজার ৩১১ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়েছে।

আঞ্চলিক কৃষি দপ্তর আরো জানিয়েছে, রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে সর্বোচ্চ পান চাষ হয় রাজশাহী জেলাতেই। ২০১৯-২০ কৃষিবর্ষে এই জেলায় ৪ হাজার ৩১১ হেক্টর পান বরজে উৎপাদন হয়েছে ৭২ হাজার ৩৩০ টন পানপাতা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ