Header Ads Widget

Responsive Advertisement

সাম্প্রতিক খবর

6/recent/ticker-posts

পুঠিয়ায় চার পুরুষ ধরে নেই আঙ্গুলের ছাপ!

স্টাফ রিপোর্টার: সাত বছর বয়সে বধূ হয়ে স্বামীর বাড়িতে এসেছিলেন সুমিতা সরকার। নেহাতই শিশু ছিলেন তখন। ওই বয়সে স্বামী-সংসার কিছুই বুঝতেননা তিনি। কিন্তু স্বামী জগবন্ধু সরকারের হাত-পায়ে সমস্যা টের পেতেন ঠিকই।

সুমিতা সরকার জানিয়েছেন, তার স্বামী শৈশবে বাবা হারিয়েছেন। তিনি ছিলেন শ্বশুরের একমাত্র সন্তান। স্বামীর কাছে শুনেছেন, এই সমস্যা তার শ্বশুরেরও ছিলো। তিনিও ছিলেন বাবার একমাত্র সন্তান। তার ধারণা, শ্বশুরের বাবারও এই সমস্যা থাকতে পারে।

জগবন্ধু-সুমিতা দম্পতির ৪ ছেলের প্রত্যেকেই জন্ম নেন বিরল এই বংশগত সমস্যা নিয়ে। মেজো ছেলে অমল সরকারের (৪৭) দুই সন্তান-অপু সরকার (২২) ও অনু সরকার (১৫) বিরল এই বংশগত সমস্যায় ভুগছেন।

অপু সরকার মেডিকেল এসিসটেন্ট এবং তার ভাই অনু সরকার পচামাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আঙুলের ছাপ না থাকায় পদে বেশি ভুগতে হচ্ছে তাদের।

জগবন্ধু-সুমিতা দম্পতির বড় ছেলে নিরাঞ্জন সরকারও (৫৮) দুই ছেলের জনক। তার ছোট ছেলে আদিত্য সরকার (২০) পরম্পরায় জন্মেছেন এই সমস্যা নিয়ে। ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আদিত্য। তিনিও পড়ছেন ভোগান্তিতে।

নিরাঞ্জন সরকারের ছোট ভাই গোপেশ সরকার (৪৫) এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কারো বংশগত এই সমস্যা নেই। পরম্পরায় এই সমস্যা ফিরবে কি-না এনিয়ে সন্দিহান তারা।

২০০৮ সালের আগে এই সমস্যা সমস্যাই মনে হয়নি পেশায় কৃষক অমল সরকারের। কিন্তু ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্রে আঙুলের ছাপ দিতে গিয়ে প্রথমবারেরমত দিনি বিড়ম্বনায় পড়েন। বার বার চেষ্টা করেও আঙুলের ছাপ নিতে পারেননি ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা। শেষে তার জাতীয় পরিচয়পত্রে ‘আঙ্গুলের ছাপ নেই’ লিখে দেন সংশ্লিষ্টরা।

এরপরের প্রায় এক দশক কোন সমস্যাই ছিলোনা। কিন্তু ২০১৬ সালে মোবাইল সিম কার্ডের জন্য বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক হবার পর অমল সরকার ফের বিড়ম্বনায় পড়েন। স্ত্রীর নামে নেয়া সিম এখন ব্যবহার করছেন অমল সরকার। তার দুই ছেলে অপু ও অনুর ব্যবহৃত সিমগুলো একই নামে নেয়া।

২০১০ সাল থেকেই পাসপোর্ট ইস্যুর জন্য আঙ্গুলের ছাপ বাধ্যতামূলক। একই নিয়ম ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রেও। কিন্তু সার্জন দপ্তরের মেডিকেল বোর্ড থেকে পাওয়া স্বাস্থ্য সনদ দেখিয়ে বছর ঘুরে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন অমল সরকার। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স হাতে পাননি এক বছরেও।

আরেক ভাই গোপেশ সরকার প্রায় দুই বছর অপেক্ষা করার পর স¤প্রতি পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। আঙুলের ছাপ না থাকায় গোপেশ সরকার হাসপাতালে ডিজিটাল হাজিরার পরিবর্তে পুরনো পদ্ধতিতে খাতায় স্বাক্ষর করেন। বড়ভাই নিরাঞ্জন সরকারের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা।

পৌঢ়া সুমিতা সরকার স্বামীকে হারিয়েছেন বহু আগে। মেজো ছেলে অমল সরকারের পরিবারে বাস করছেন তিনি। অমল সরকার রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের পচামাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা।

তার বড় ভাই নিরাঞ্জন সরকার সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে যশোর জোনাল ভূমি অফিসে কর্মরত। স্থায়ী নিবাস পুঠিয়ায় হলেও চাকরি সূত্রে নিরাঞ্জন সরকার বাড়ির বাইরে অবস্থান করেন।

ছোটভাই গোপেশ সরকার দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের রেডিও টেকনোলজিস্ট। পরিবার নিয়ে তিনি সেখানকার নিমনগর বালুবাড়ি এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় অমল সরকারের সাথে। তিনি জানান, প্রথম সমস্যা ধরা পড়ে জাতীয় পরিচয়পত্রে আঙুলের ছাপ দিতে গিয়ে। এরপর সমস্যা হয়েছে মোবাইলের সিম তুলতে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েন পাসপোর্ট নিতে গিয়ে। নির্ধারিত আবেদন ফরম জমা দেয়ার পর মোবাইলে ক্ষুদেবার্তা পেয়ে তিনি ছবি এবং আঙুলের ছাপ দিতে পাসপোর্ট দপ্তরে যান।

বহু চেষ্টার পরও সেখানকার কর্মীরা তার আঙুলের ছাপ নিতে পারেননি। শেষে এক জনকে ধরে সিভিল সার্জনের দপ্তরে যান। সেখানকার দেয়া মেডিকেল সনদ জমা দিয়ে এক বছর পর হাতে পেয়েছেন পাসপোর্ট।

কিন্তু আঙুলের ছাপ বিড়ম্বনায় এখনো ড্রাইভিং লাইসেন্স পাননি বলে জানিয়েছেন অমল সরকার। তিনি বলেন, তবে নানান তদবির করে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন করেছেন। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় পথে নামছেন বিআরটিএ তে ফি জমা দেয়ার রশিদ দিয়ে।

অনেক সময় দায়িত্বরত সার্জেন্ট বিষয়টি আমলে নেন। কখনো কখনো মামলা দেন। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় পদে পদে তাকে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে।


অমল সরকার আরও জানান, বিরল এই সমস্যা তার বাবার ছিলো। বাবার মুখে শুনেছেন একই সমস্যা ছিলো দাদা এমনকি তার বাবারও। কৃষিকাজ করতেন বিধায় তারা কখনো এটি সমস্যাই মনে করেননি। কিন্তু এখন নানান সেবার ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপ বাধ্যতামূলক হওয়ায় তিনি ও তার পরিবার চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন। বিষয়টি তার কাছে চরম অস্বস্তির বলে জানান অমল সরকার।

অমল সরকারের ছেলে অপু সরকারের ভাষ্য, জন্মের পর থেকে এমন হাত দেখে আসছেন তিনি। ফলে এটি তার কাছে সমস্যাই মনে হয়নি। কিন্তু অন্য মানুষের থেকে আলাদা তা বুঝতেন।

মূলত: বায়োম্রেট্রিক সিম রেজিস্ট্রেশন থেকে তার সমস্যার শুরু হয়। এরপর তার বাবা মোটরসাইকেল কিনলেন। গাড়ির কাগজপত্র পেতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর পাসপোর্ট হাতে পেলেও এখনো মেলেনি ড্রাইভিং লাইসেন্স।

অপু জানান, এখন তারা যে সিম ব্যবহার করেন সবগুলোই তার মায়ের নামে তোলা। সিম সংক্রান্ত সমস্যা হলেই বড় ধরণের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। তবে স্বাস্থ্য সনদ দেখিয়ে স¤প্রতি তিনি ও তার বাবা জাতীয় পরিচয়পত্রের স্মার্টকার্ড করেছেন। আঙুলের ছাপের বিকল্প থাকলে তারা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে মনে করেন অপু।

অপু সরকার জানিয়েছেন, বিষয়টি গণমাধ্যমে আসায় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাদের বাড়িতে এসে নমুনা নেয়ার কথা জানিয়েছেন। প্রয়োজনে তাদের ঢাকায় নেয়ার কথাও জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

এবিষয়ে উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুল জানান, এই পরিবারের ছয়জন সদস্য বিরল এই রোগে আক্রান্ত। তাদের তিন ভাইয়ের দুজন সরকারী চাকরি করেন। তাদের ছেলেরা ভবিষ্যতে চাকরিতে যাবেন।

তিনি যতদূর জেনেছেন, এটি প্রকৃতিগত সমস্যা। এনিয়ে আসলে তেমন কিছুই করার নেই। আঙুলের ছাপ ছাড়া কোন সেবা প্রয়োজন হলে সেটি ইউনিয়ন পরিষদ নিশ্চিত করবে।

আঙুলের ছাপ না থাকা ‘অ্যাডারমাটোগ্লিফিয়া’ বা ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ’ হিসেবে ধরে নিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এই পরিবারটি এই সমস্যায় ভুগছে কি না তা নিশ্চিত নয় স্থানীয় স্বাস্থ্য দপ্তর। খুব শিগগিরই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিষয়টি নিশ্চিত হবার চেষ্টাও চলছে।

এর আগে এই বছরের ১৫ মার্চ অমল সরকারকে মেডিকেল সনদ দেয়া স্বাস্থ্য সনদে এই সমস্যাকে ‘কনজেনিয়াল পালমোপ্লান্টার কেরাটোডার্মা’ হিসেবে চিহ্নিত করেন সিভিল সার্জন দপ্তরের তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। আর এই কারণেই তার আঙুলের ছাপ দেয়া সম্ভব নয় বলেও জানায় বোর্ড।

কেবল স্বাস্থ্য সনদ দিয়েই দায় সেরেছেন তৎকালীন জেলার সিভিল সার্জন ডা. এনামুল হক। পদোন্নতি বৃহস্পতিবার (৩১ ডিসেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক হিসেবে তিনি যোগদান করেন।

মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে ডা. এনামুল হক বলেন, আসলে বিষয়টি দায়িত্ব এড়ানো নয়, এই সমস্যাটি বিরল। এনিয়ে দেশে কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। কাজেই তাদের সেই যাত্রাই থেমে যেতে হয়েছে।

তিনি দাবি করেন, এখন উপজেলা স্বাস্থ্য দপ্তর উপর লেবেলে চিঠি চালাচালি চলছে। এনিয়ে আরো বিশেষজ্ঞ মতামত প্রয়োজন। নির্দেশনা পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে, বিবিসি জানাচ্ছে, সুইটজারল্যান্ডের একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পিটার ইটিন এবং আরও কয়েকজন গবেষক এ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন ২০১১ সালে। ওই গবেষণায় তারা এই বংশগত বা জেনেটিক সমস্যার জন্য দায়ী জেনেটিক মিউটেশনটি শনাক্ত করেন।

তাদের গবেষণার সময় পর্যন্ত সারা বিশ্বে মোট চারটি পরিবার শনাক্ত হয়েছিল, যারা বংশগতভাবে এই সমস্যায় ভুগছেন। এর সবগুলোই ছিল এশিয়া মহাদেশের বাইরে।

২০০৭ সালে এক সুইস নারী আঙ্গুলের ছাপ দিতে না পারায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরে বারবার সমস্যায় পড়ার পর অধ্যাপক ইটিনের শরণাপন্ন হন। সেটিই ছিল তার কাছে এ ধরণের প্রথম কোন রোগী। পরবর্তীতে গবেষক দলটি ওই নারীর পরিবারের ১৬ জনের ওপর গবেষণা চালিয়ে বংশগত সমস্যার কারণটি খুঁজে বের করেন।

গবেষকদলটি এই রোগের আরেকটি নাম দেন – ‘অভিবাসন বিলম্ব রোগ’ বা ‘ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ’। তবে এই বিড়ম্বনা এখন শুধু বিমানবন্দরেই সীমাবদ্ধ নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ